গত ৯ অক্টোবর ঘটে যাওয়া এ ঘটনার বিবরণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাতুল শেয়ার করলে তা দ্রুত ভাইরাল হয় এবং ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
তার পোস্টে রাতুল জানান, হাসপাতালে অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে তিনি হেনস্তার শিকার হন। পোস্ট অনুযায়ী, আনসার সদস্যরা তাকে জোরপূর্বক টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে নির্যাতন করেন। আনসার সদস্য ও হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক মিলে তাকে লাঠি, রড দিয়ে এলোপাথাড়ি মারধর করেন এবং একপর্যায়ে তাকে উলঙ্গ করে পেটানো হয়। নির্যাতনে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার মা হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে রাতুল সেখানে নেই এবং গণপিটুনিতে মারা গেছেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এ অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং আনসার সদস্যদের ভূমিকা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে দাবি করে। বাহিনীর উপ-পরিচালক ও গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকউজ্জামান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, ৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালের ক্যানসার ভবনে আল্ট্রাসনোগ্রামের জন্য আসা রোগীদের ভিড়ের কারণে বাগবিতণ্ডা হয় এবং আনসার সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরপর দুই ব্যক্তি হাসপাতালের রেজিস্টার কক্ষে অনধিকার প্রবেশ করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে তাদের শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়।
তবে হাসপাতালটির জন্য এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগেও গত ৬ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট ইউনিট বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালায়। ওই অভিযানে সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক বরাদ্দ করা অর্থ আত্মসাৎ, রোগীদের জন্য নির্ধারিত ওষুধ ও অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান করে দুদক এনফোর্সমেন্ট। অভিযান পরিচালনাকালে রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র, রেজিস্টার বই যাচাই করা হয়। এনফোর্সমেন্ট দল সেবার মান বৃদ্ধি ও সমাজসেবা কার্যক্রমে আরও স্বচ্ছতা আনয়নে পরামর্শ দেয় যেন অসহায় দুস্থ রোগীরা কোনো ধরনের ভোগান্তির শিকার না হন।
এসব অনিয়ম শুধু রাজধানীর হাসপাতালেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৬৮টি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধেও অনুরূপ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুদক। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৪১ জেলার ৬৮টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অভিযান ও গোপন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ সব অনিয়মের তথ্য।
দুদকের অনুসন্ধানে বিভিন্ন ধরনের গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়ে। তার মধ্যে রয়েছে- রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা খাবার কম দেওয়া ও খাবার নিম্নমানের হওয়া, রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ না দিয়ে বাইরের দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করা, অতিরিক্ত ফি আদায়, রোগ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না ব্যবহার করা, চিকিৎসক উপস্থিত না থাকা, অপরিচ্ছন্ন চাদর ও বিছানার ব্যবহার, কেনাকাটা ও নিয়োগে অনিয়ম, দায়িত্বে চরম অবহেলা ইত্যাদি।
গত ৮ অক্টোবর নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অভিযান চালায় দুদক। অভিযানকালে দুদকের দলের সদস্যরা ছদ্মবেশে রোগী সেজে স্বাস্থ্যসেবার মান পর্যবেক্ষণ করেন এবং আউটডোর ও ইনডোর বিভাগের রোগীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করেন।
এনফোর্সমেন্ট দল জানায়, রোগীদের জন্য সরবরাহ করা পথ্যের মান যাচাইয়ে দেখা যায়, ডায়েট চার্ট অনুযায়ী দুপুরের খাবারে ২০০ গ্রাম সিলভারকার্প মাছ দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে প্রায় ৫০ গ্রাম মাছ পরিবেশন করা হচ্ছে। এছাড়া ডায়েট চার্টে নির্ধারিত বিআর-২৯ চালের পরিবর্তে নিম্নমানের মোটা চাল ব্যবহার করা হচ্ছে।
গত ৭ অক্টোবর ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অভিযান চালায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট দল। হাসপাতালটিতে ২০ জন চিকিৎসক পদের বিপরীতে মাত্র চারজন চিকিৎসককে কর্মরত দেখা যায়। হাসপাতালটির জেনারেটর নষ্ট অবস্থায় পাওয়া যায়। আর অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক ও গাইনি চিকিৎক না থাকায় সিজার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানায় দুদক।
এছাড়া, গত ২৯ সেপ্টেম্বর নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অভিযান চালায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। এ সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের বায়োমেট্রিক হাজিরা তালিকা সংগ্রহ করে তারা। এছাড়া, হাসপাতালের স্টোর হাউজে সংরক্ষিত স্টক রেজিস্টার ও ওষুধ বিতরণের হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, হাসপাতালের সার্বিক পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন; বিশেষত বাথরুমগুলো অত্যন্ত নোংরা ও ব্যবহার অনুপযোগী। বায়োমেট্রিক হাজিরা তালিকা অনুযায়ী চিকিৎসকরা নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না বলে জানায় দুদক। আর বহির্বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে ওষুধ বিতরণে অনিয়মের বিষয়টিরও প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কথা জানায় দুদক।
এমন অভিযোগের কথা জানান গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীরাও। তাদের ভাষ্য, প্রায়ই রোগীদের সরকারি ওষুধ না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নিচ্ছেন।
গত ১৮ এপ্রিল সালমা বেগম নামের এক রোগী জ্বর-ঠান্ডা নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসে কোনো ওষুধ না পেয়ে বাইরে থেকেই ওষুধ কিনতে বাধ্য হন। অথচ পরে দেখা যায় হাসপাতালের গুদামে পর্যাপ্ত ওষুধ মজুত ছিল। গত ২৯ এপ্রিল দুদকের এক অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। এসব অনিয়মের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মামুনুর রহমানকে অপসারণ করা হয়।
একইভাবে যশোরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালেও একই ধরনের অনিয়মের প্রমাণ মেলে। পর্যাপ্ত স্যালাইন মজুত থাকলেও রোগীদের বাইরে থেকে কিনতে বলা হয়। রোগীদের খাদ্যসেবার মান ছিল নিম্নমানের এবং পরিমাণে কম। এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়েত জাগো নিউজকে বলেন, ‘অভিযোগগুলো সত্য। অনেক চেষ্টা করেও প্রতিকার করতে পারছি না। এর সঙ্গে হাসপাতালের কিছু লোক জড়িত। যারা এখানে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’



